প্রাণিজ প্রোটিনের অন্যতম উৎস হলো ডিম। কর্মসংস্থান ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের পাশাপাশি চাহিদার ৪০ থেকে ৪৫ ভাগ মাংস ও আমিষের জোগানদাতা হিসেবেও অবদান রাখছে পোল্ট্রি শিল্প। ভুট্টা ও সয়াবিনের সমন্বয়ে অর্গ্যানিক পদ্ধতিতে বর্তমানে উৎপাদন হচ্ছে এ শিল্পের খাবার। ফলে আমিষের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে উৎপাদনও। নতুন আশা নিয়ে সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে ২০২১ সালের মধ্যে বছরে ১২০০ কোটি ডিম ও ১০০ কোটি ব্রয়লার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন পোল্ট্রি শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, ২০২১ সাল নাগাদ দেশে প্রতিদিন সাড়ে ৪ কোটি ডিম ও প্রায় ৪ হাজার টন মুরগির মাংসের প্রয়োজন হবে। তার মানে অর্থনীতিতে এই শিল্পের অবদান ও ভূমিকা ব্যাপক হওয়ার বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ পোল্ট্রি শিল্প সমন্বয় কমিটি (বিপিআইসিসি) সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে ডিমের যে চাহিদা তা অনেকটাই পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। আশার খবর হলো, এই শিল্পের উদ্যোক্তারা আবারো পোল্ট্রি পণ্য রফতানির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ডিমের খোসার ওপর সূক্ষ্ম কারুকার্য করা কিংবা ঘর সাজাতে ডিমের খোসার ব্যবহার শুরু হচ্ছে।
প্রতি বছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার পালিত হয় বিশ্ব ডিম দিবস। ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল এগ কমিশনের (আইইসি) উদ্যোগে বিশ্বের ৬০টি দেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশেও পোল্ট্রি সংশ্লিষ্ট ৭টি অ্যাসোসিয়েশনের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতর যৌথভাবে দিবসটি উদযাপন করে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এ দিবসটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। কারণ প্রতি বছর দেশে অসংখ্য শিশু এবং গর্ভবতী মা পুষ্টিহীনতার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করছেন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যমতে, সুস্থ থাকার জন্য একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে বছরে গড়ে ১০৪টি ডিম খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ বছরে ডিম খায় গড়ে মাত্র ৪৫-৫০টি। তবে আশার খবর হলো, ডিম শুধু পুষ্টি উপাদেয় খাবার হিসেবে অসুখ অসুস্থতায় অথবা অতিথি আপ্যায়নে নয়- প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ডিমের গুরুত্ব অনেকাংশে বেড়েছে। বাবা-মায়েরা সন্তানদের সুস্বাস্থ্য ও মেধাবিকাশের জন্য ডিম দিচ্ছেন নিত্যদিন। নিজেদের সুস্থতায় সকালের নাশতায় ডিম খাচ্ছেন অনেকে। ডিনারে বা লাঞ্চেও ডিমের মুখরোচক রন্ধনশৈলী জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বয়স্ক ও সন্তানসম্ভবা মায়েদেরও ডিম খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এভাবে দেশের মানুষের মাঝে ডিম সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। সন্তানের স্কুল টিফিনে ডিম দিয়ে তৈরি রকমারি নাশতা প্রাধান্য পাচ্ছে। তবে সরকারের স্কুল ফিডিংয়ে ডিম অন্তর্ভুক্ত করলে ডিমের ব্যবহার ও চাহিদা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে এবিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ করতে পারে।
বর্তমানে দেশে দৈনিক ডিম উৎপাদন হয় কমবেশি ৩ কোটি ৮০ লাখ। আমরা যদি গড়ে ৭ টাকা করে একটি ডিমের দাম ধরি, তাহলে ডিমকে কেন্দ্র করে দৈনিক ২৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা, মাসে ৮০৯ কোটি এবং বছরে ৯ হাজার ৭০৯ কোটি টাকার লেনদেন হয়। পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, সারা দেশে বর্তমানে প্রায় ৬৫-৭০ হাজার ছোট-বড় খামারে প্রতিদিন ডিম উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ২ কোটি ২০ থেকে ২৫ লাখ। আগে হ্যাচিং ডিম আমদানি করতে হতো। এখন বাংলাদেশে ৭টি গ্রান্ড প্যারেন্টস্টক (জিপি) ফার্ম আছে। প্যারেন্টস্টক বা পিএস ফার্মের সংখ্যা ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৮০টি। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন দিয়েই দেশের হ্যাচিং ডিমের শতভাগ চাহিদা পূরণ হচ্ছে। ২০১৪ সালে প্রতিদিন ডিম উৎপাদন হতো প্রায় ১ কোটি ৭৫ লাখ। বছরে উৎপাদন ছিল প্রায় ৬৩৯ কোটি। মাথাপিছু খাওয়া হতো প্রায় ৪১টি। ২০১৫ সালে প্রতিদিন ডিম উৎপাদন হতো প্রায় ১ কোটি ৯৫ লাখ। বছরে উৎপাদন ছিল প্রায় ৭১২ কোটি। মাথাপিছু খাওয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৫টি। ২০১৬ সালে দিনে উৎপাদন হতো প্রায় ২ কোটি ২০ থেকে ২৫ লাখ। বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৮২১ কোটি। বর্তমানে মাথাপিছু খাওয়া হয় প্রায় ৫১টি। এই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালে দৈনিক উৎপাদন হবে প্রায় ৪ কোটি ৫ লাখ ডিম। আর তখন মাথাপিছু কনজাম্পশন হবে প্রায় ৮৬টি।
বিপিআইসিসি সূত্রে জানা গেছে, আগে হ্যাচিং ডিম আমদানি করতে হতো। এখন বাংলাদেশে গ্রান্ড প্যারেন্টস্টক (জিপি) ফার্ম আছে। প্যারেন্টস্টক বা পিএস ফার্মের সংখ্যা ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৮০টি। আশার খবর হচ্ছে, এখন অভ্যন্তরীণ উৎপাদন দিয়েই দেশের হ্যাচিং ডিমের শতভাগ চাহিদা পূরণ হচ্ছে। আধুনিক হ্যাচারিগুলোতে যান্ত্রিক উপায়ে সপ্তাহে এক কোটি ১০ লাখেরও বেশি ডিম ফোটানো হয়। মুরগি পালনের ক্ষেত্রেও যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। খাবার ও পানি সরবরাহ, ডিম সংগ্রহ সবকিছু স্বয়ংক্রিয় উপায়ে করা হয়। ফলে ভোক্তারা সহজেই স্বাস্থ্যকর-জীবাণুমুক্ত ডিম ও মুরগির মাংস পাচ্ছেন।
মেধাবী ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গঠনে এবং পুষ্টির ঘাটতি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে এই পোল্ট্রি শিল্প। এ খাত সংশ্লিষ্টদের নিরবচ্ছিন্ন ভূমিকার ফলে দেশ এখন মুরগির ডিম ও মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এমনকি দেশের ডিম ও মাংসের শতভাগ চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি অতিরিক্ত উৎপাদন হচ্ছে। ফলে দেখা দিয়েছে রফতানির সম্ভাবনাও।
জানা গেছে, ২০০৫ সালের আগেও দেশের চাহিদা মিটিয়ে ডিম বিদেশে রফতানি হতো। কিন্তু ২০০৭ ও ২০০৯ সালে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়ায় পোল্ট্রি শিল্পে বিপর্যয় নেমে আসে। বার্ড ফ্লু আঘাত হানায় ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর অ্যানিমেল হেলথের (ওআইই) শর্তের কারণে পোল্ট্রির রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ধকল কাটিয়ে আবারো বাংলাদেশ থেকে ডিম রফতানির স্বপ্ন দেখছেন উদ্যোক্তারা।
পোল্ট্রি শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। জানা গেছে, ১৯৭৪ সালে ছয়টি পোল্ট্রি ফার্ম স্থাপনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এ শিল্পের যাত্রা শুরু হলেও ১৯৮০ সালের দিকে বাণিজ্যিকভাবে পোল্ট্রি শিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকে। গত তিন দশকে তা দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প খাতে রূপ নিয়েছে। প্রায় ৬০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শিল্পের ওপর নির্ভরশীল।
লেখক : কৃষি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
writetomukul36@gmail.com